যতদূর পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে আমি খুব একাএকাই ছিলাম। সময় কেটেছে মূলতঃ বইয়ের সঙ্গে আর নিজের মনেমনে অনন্তর কথা বলে। মা-বাবাকে তেমন করে কাছে পাইনি, বরং তাঁরা ভয় আর ভুলবোঝাবুঝির কারণই হয়েছিলেন অনেক বেশি। কাউকে দোষ দিতে চাইনা, অনেক দোষ আমারই। দাদু-দিদার অনেক আদর, অকুন্ঠ স্নেহ পেয়েছি, সেকথা পঞ্চমুখে স্বীকারও করে এসেছি সারাটা জীবন, আর সেই স্বর্গসুখ হারানোর দুঃখও কোনদিন ভুলতে পারলাম না। বড় হতে হতে অনেক কথা বলার তাগিদ অনুভব করতে লাগলাম, শিক্ষকতা করার কাজটাও শুরু হয়ে গেলো অত্যন্ত কম বয়স থেকে, করতে গিয়ে দেখতে পেলাম পড়ার বাইরেও অনেকে আসে আমার সঙ্গসুখ পেতে, আর সে তৃপ্তি অন্যকে দিতে দিতে মনে হতে লাগলো আমিও পরম তৃপ্তি পাচ্ছি। তাই থেকে গেলাম এ'কাজ নিয়েই। আজ প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। অনেক কিছু পেয়েছি, হারিয়েছিও অনেক কিছু। অন্য মানুষকে চির-মূল্যবান কিছু দিতে পারবো বলে যে বিশ্বাস একদা জন্মেছিলো তা ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। ডানাভাঙা পাখি ডানা জুড়ে যাওয়া পর্যন্তই কাছে থাকে, সেবা-স্নেহ নেয়, তারপর অবধারিতভাবে বাসা ফেলে উড়ে যায়, পিছন ফিরে আর দেখে না। সবাই 'বড়' হয়ে যায়, সবার কর্মময় ব্যস্ত জীবন হয়ে যায়, সবার কাছে ক্রমশ অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক, বোঝা হয়ে যাই। সবাই, সবাই। কারো মোহ কাটতে ছ'মাস লাগে, কারো বিশ বছর, এইটুকুই যা তফাৎ। তবে আসলে তো পাখি নয়, মানুষ, তাই অনেকে শুধু ভুলে গিয়েই ক্ষান্ত দেয় না, নিজে ভুলে গিয়ে আশা রাখে যে সে কিন্তু চিরটাকাল আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করবে! অনেকে আবার গালিও দেয়। মানুষ তো! শুধু করুণ হাসি পায় ভাবতে যে কতজনই না বলে গেলো 'আমি তোমায় কোনদিন ভুলবো না, চিরকাল যোগাযোগ রাখবো'!
Abou ben Adhem কবিতায় লেখা আছে, যে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, ঈশ্বর তাকেই সবচেয়ে বেশি স্নেহ করেন। কেন করেন? সবাই মানুষকে ভালোবাসে না কেন? কারণ বলা অতি সোজা, কাজটা প্রায় অসম্ভব।এটুকু খুব দুঃখময় গর্ব করেই বলবো, আমার মতো এতকাল ধরে খুব বেশি লোক প্রাণপণে চেষ্টা করে দেখে না। এক তো আমার নিজের অনেক দোষ, ঈর্ষা ক্রোধ ভয় কুসংস্কার দ্বেষ সংকীর্ণতা-ভরা মন, সে মন খুলে মানুষকে ভালোবাসা যে বিষম কাজ! যদি বা প্রাণের তাগিদে সেসবের হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পেলাম, উর্দ্ধে উঠলাম, কিন্তু মানুষ ভালোবাসা নিতে পারে কৈ? সব তো দু'দিনের। তারা শুধুই ভালোবাসা চায়, দিতে নাচার, যা দেয় তাও ক্ষনিকের, তারপর ভুলে যায়, ছেড়ে যায়, মন বদলে ফেলে, অন্যত্র সে জিনিস খোঁজে। কেউ কেউ মুখে লাথি মেরেও যায়, মজা পায়। তারপর এও সত্যি, যে 'বড়' হতে হতে সবাই আস্তে আস্তে আমার বহু দোষত্রুটি আবিষ্কার করে, সেগুলোই মনের ভিতর অন্ধকার ছেয়ে দেয়, তখন যা কিছু একসময়ে ভালো লেগেছিলো তা আর মনে পড়ে না। অনেকের কাছেই আবার তর্কে জয়-পরাজয়টা বড় হয়ে দাঁড়ায়, 'আমি ঠিক' এটাই যেমন করে হোক প্রমাণ করতে হবে, ওসব ভালোবাসা-টালোবাসায় গুলি মারো। আর সেরকমভাবে যখন আমার বিচার হয়, তখন নিজের অজান্তেই এভাবে চিন্তা করে... 'উনি কেন সর্বগুণসম্পন্ন নন?' যেন আমাকে বাদ দিয়ে তারা অনেক perfect মানুষ দেখে এসেছে, আর তাই যদি না হলাম তো ভালোবাসবে কী করে? - কে পারবে এইরকম মাপকাঠিতে উৎরে যেতে?
তো আমি আজকাল প্রায়শঃই বলে থাকি যে আর মানুষকে ভালোবাসতে পারি না, হাল ছেড়ে দিয়েছি। স্বভাব যায়না ম'লে, তাই বোকার মতো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখনো চেষ্টা করে যাই, তবে জানি, ব্যর্থ হওয়াই আছে কপালে। আসলে না, ন্যাড়া বেলতলায় যেতেই থাকে, শিক্ষা হয় না! তবে হ্যাঁ, এটা বুঝি, ভগবান বুদ্ধ কেন বলে গেছেন জীবন দুঃখময়, খৃষ্টধর্মেও কেন বলে this world is a vale of tears. জৈন মহামুনিদের তো বলাই হয় 'তীর্থঙ্কর', অর্থাৎ কিনা যাঁরা বৈতরণী পার হতে সাহায্য করেন।
তাই এই মানসিক অবস্থায় বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার অন্তত অপার বিস্ময় লাগে এই দেখে যে আমার থেকেও যাঁরা অনেক বেশিদিন বেঁচেছেন, জীবনযুদ্ধের জ্বালায় জেরবার হয়েছেন, তাঁদেরও কেন মরতে এত ভয়, এই জীবনকে আঁকড়ে থাকার এত আকুতি! ঢের তো দেখলি বাবা, এখনো আশ মিটলো না?