She(y)

আস্তে আস্তে স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে আকাশ ঘন কালো মেঘে সজল হয়ে উঠলো, চারিদিকে নিবিড় স্নেহভরা প্রশান্ত অন্ধকার ছেয়ে এলো, ভারী স্নিগ্ধ গা শিরশিরে একটা মৃদুমন্দ বাতাস এসে সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো পরম যত্নে; জানালা দিয়ে দেখলেম, মাধবীলতা কেঁপে উঠেছে অনির্বচনীয়  সেই স্পর্শে - তখন দেখি সে নিঃশব্দে ধীরপদে এসে ঢুকেছে আমার একলা ঘরে।  কতকাল বাদে দেখা, তবু নতুন করে চিনতে হলো না; সে তো কখনো আমায় ছেড়ে যায় নি, শুধু আড়ালে সরে ছিল এতদিন, আবার আবরণ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে আজকে, এই তো। 

চুপটি করে বসলো আমার পাশ ঘেঁষে। অনেকক্ষণ চোখের পলক পড়ে না, নির্বাক চেয়ে আছে মেঝের দিকে, নিশ্বাসের সঙ্গে বুকটি শুধু থেকে থেকে ওঠানামা করছে, এতটুকু চিত্তচাঞ্চল্য প্রকাশ করে ফেলেই বুঝি লজ্জায় জড়সড়। তারপর উঠে গেল জানালার কাছে; গরাদে হাত রেখে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো নিরুদ্দেশের পানে; দূরে তালগাছের পাতা সরসরিয়ে বাতাস এসে লাগছে ওর আঁচলে, সারা গায়ে ঢেউ খেলিয়ে ভিজে চুলের গন্ধ মেখে এসে মৃদু তিরস্কারের ঝাপটা মেরে যাচ্ছে আমার মুখে। 

নীল বিদ্যুত তীরের মত আকাশের বুক চিরে মুহুর্তের জন্য ওর মুখখানি উদ্ভাসিত করে, আমার বুকে শেল দিয়ে নিঃশেষে মিলিয়ে গেল; আরো ঘন অন্ধকার ঘরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল আবার। তখন যত দেখলুম তার চেয়ে ঢের বেশি অনুভব করলুম, সে ভীত হরিণীর মত ত্রস্তপদে এসে আবার বসলো আমার পাশটিতে। মাথাটি ঝুঁকে পড়ল আমার কাঁধে। সেই অন্ধকারেও তার অতলস্পর্শ কালো চোখ  দেখতে পেলুম, তাতে টলটল করছে দুটো মুক্তো। তারপর ঠোঁট নড়ল, বুকের মধ্যে তার বুকভাঙ্গা প্রশ্ন শুনতে পেলুম - 'তবে কি তুমি ভুলে গেছ আমায়? আর কি তবে আমাকে তোমার দরকার নেই?'

মুখে কথা সরল না, চোখের পলক পড়ল না, শুধু অন্তরাত্মা অবধি তোলপাড় করে হাহাকার উঠলো - 'আছে, আছে, তোমাকে আমার দরকার  আছে আজও। তুমি ছাড়া এ মহাবিশ্বে আমার কেউ নেই, আমি একা, আমি অনন্যগতি, আমি তোমারই।'

তখন চোখের মুক্তো ঝরে পড়ল, তখন কালো অন্ধকারে আলোঝলমলে অনাবিল স্বস্তির হাসি তার ঠোঁট থেকে উপছে পড়ে আবার আমার ঘর উদ্ভাসিত করে দিল, তখন পরম তৃপ্তিতে দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে সে মুখ লুকোলো আমার বুকে। আমি তাকে টেনে নিলেম গভীর আলিঙ্গনে।

তারপর বৃষ্টি নামল। আস্তে আস্তে সে আবার মিলিয়ে গেল পঞ্চভূতে। - তার চুলের অন্ধকার মেঘের গভীর কালোয়, তার অঙ্গের সুবাস ভেজা মাটির গন্ধে, তার চোখের জলের স্পর্শ খোলা জানালা দিয়ে আসা বর্ষণস্নাত দমকা হাওয়ায়। আমার কাছে পড়ে রইলো শুধু তার গলা থেকে খসে পড়া ফুলের মালাখানি। 

[My first ever post in Bangla. Written 23 years ago. Those who can see a great deal of Tagore here need not be surprised or suspect a coincidence - this was at a time I was immersed in him for a couple of years at a stretch, translating some of his works. The more interested and diligent of my readers might care to find out and tell me just which of his little essays inspired this one...]