পুপুরানী যখন খুব ছোট্টটি ছিল তখন একবার দাদু দিদাকে নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখতে গেছিল। সেখানে কেঁদো বাঘের চেহারা আর রকম সকম দেখে তো তার চক্ষু স্থির। বাড়ি ফেরা অবধি তার শান্তি নেই, কতক্ষণে বাবাকে গিয়ে খবরটা দেওয়া যায়। তারপর যখন সে চোখ পাকিয়ে ইয়া বড়া হাঁ করে 'হালুম!' বলেছে তখন বাবা কি ভয়ানক রকম ভয় পেয়ে গেছে তা দেখে তো সে হেসেই কুটিপাটি।বাবাটি যে তার এতবড় একটা ভীতুর ডিম এ'খবরটা তার এতদিন জানাই ছিল না। অতঃপর বেশ কিছুদিন ধরে চলল তার এই বাবাকে ভয় দেখানোর খেলা। তারপর একদিন বোধ করি তার মায়া হল, তখন সে বলল, 'বাবা, তুমি বাঘ দেখতে যাবে? ভয় নেই, আমি নিয়ে যাব সঙ্গে করে।'
কথাটা অবিশ্যি ঠিক অমনি করে বেরোল না - পরিষ্কার করে বলার মত বয়স হয়নি তো। বাবাকে বুঝে নিতে হয়েছিল। ক্রমশ পুপুর খেয়াল হলো, এখন থেকে তার নাম হবে 'শোত্তো বাঘ'। বাবা তাকে রাতে ঘুম পাড়াবার সময়ে গান গাইত তো, তারপর কবে যেন একটা শোত্তো বাঘের গল্প বলে ফেলেছিল, সেই থেকে পুপুর নেশা হয়ে গেল, সে খালি বাঘের গল্প শুনবে। বাবা যত তাকে এটা ওটা অন্য সব গল্প শোনায়, সে ভোলবার পাত্রী নয়। টুনটুনির গল্প, বুদ্ধু ভুতুমের গল্প, আলাদিনের গল্প, সিনডেরেলার আর ঘুমন্ত রাজকন্যার গল্প, সব শুনেটুনে শেষে বলে, 'এবা-র একটা বাঘের গপ্প বল, ভালো বাঘ, শোত্তো বাঘের গপ্প।' বাবা পড়ল মহা মুশকিলে। রোজ অত নতুন নতুন ছোট্ট বাঘের গল্প কোথায় পায়? শেষটায় একদিন নিজেই গপ্প ফেঁদে বসল। .....
ছোট্ট বাঘটা ছিল খুব ছটফটে। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই তার গুহা থেকে লাফিয়ে খেলতে বেরিয়ে যাওয়া চাই। ঢের বন্ধুবান্ধব তার, তাদের সঙ্গে নিয়ে সে রোজ নিত্যনতুন জায়গায় খেলতে যায়। মা তার প্রায়ই বলে, বেশি দূর যাসনে খোকা, গুরুজনদের কথা অমান্য করিসনে - কিন্তু কে শোনে সেসব কথা? অত সাবধান হলে সব মজাটাই মাটি হয়ে যাবে না? অবিশ্যি সর্দারিতে তার প্রানের বন্ধু মোট্টুরাম হাতির ছানাও কিছু কম যায় না। তার সঙ্গে সব খেলাতেই আছে, আবার বড়দের মত সমানে পিছন থেকে টিকটিক করতেও ছাড়ে না। এমন বিজ্গের মত সব উপদেশ দেয় যেন তার নিজের বয়স তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। ছোট্ট বাঘ খুব বেশি দুষ্টুমি করলে বলে 'দাঁড়া, তোর বাবা ঘরে ফিরলে বলে দেব।' বাবাকে ছোট্ট বাঘ একটু সমীহ করে চলে কিনা! তাতেও কাজ না হলে তখন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে- 'আমার দাদুকে বলে দেব কিন্তু!' ব্যাস, ছোট্ট বাঘ এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে যায়। না হয়ে উপায় কি? বুড়ো সর্দার দাদু হাতি হলেন গিয়ে জঙ্গলের রাজা। পাহাড়ের কোলে কাকচক্ষু অতল হ্রদের ধরে দাঁড়িয়ে ঢুলুঢুলু চোখে দুলতে দুলতে তিনি শুঁড় দোলান, জঙ্গলের সকল জীব প্রয়োজনে তাঁর কাছে সাহায্য বা আশ্রয় চাইতে যায়। তিনি যখন মাটি কাঁপিয়ে বিশাল দুই দাঁত বাগিয়ে ধীর পায়ে হাতির পালের আগে আগে চলেন, তখন বাবা বাঘ, যিনি কাউকে ভয় পান না, তিনি পর্যন্ত রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ছায়ার মত ঝোপঝাড়ে ঢুকে যান। সেই দাদু হাতির সামনে আসামী হয়ে দাঁড়াতে হলেই হয়েছে আর কি!
তাই বলে যেন মনে কোরো না যে মোট্টুরাম হাতির ছানা নিজে একটি হাবাগোবা নিরীহ ভালোমানুষ! মোটেই না - মাথাটা তার ভারী ঊর্বর, আর বদমায়েশি বুদ্ধিতে ঠাসা। নতুন নতুন খেলা বানাতে যেমন সে ওস্তাদ, বন্ধুকে ভয় দেখাতে আর পিছনে লাগতেও তেমনি। (ছোট্ট বাঘ আমাদের ভারী সরল কিনা, তাই তাকে বোকা বানানোও খুব সহজ, এটা আবিষ্কার করতে মোট্টুরামের বেশিদিন সময় লাগেনি।) একবার শুঁড় দিয়ে মৌচাকে ঢিল মেরে নিজে মৌমাছিদের খেপিয়ে আগেভাগে সরে পড়ে সে খোকা বাঘকে যারপরনাই নাস্তানাবুদ করেছিল; সে বেচারা মৌমাছিদের হাত থেকে পালাবার পথ পায় না, কামড় খেয়ে একসা হয়েছিল, অনেকদিন লেগেছিল গায়ের ব্যথা জুড়োতে। আরেকদিন একগাছি আখ এনে মোট্টুরাম তাকে চিবোতে দিয়েছিল, বলেছিল 'তুই তো মাংসের হাড় খাস কড়মড়িয়ে, এটাতে তোর একটুও অসুবিধে হবে না, খেয়ে দেখ কি দারুন মিষ্টি!' সে বেচারা আখ চিবোতে গিয়ে কি বিচ্ছিরি নাজেহাল হয়েছিল কি বলব। আখের ছিবড়ে গিয়েছিল দাঁতের ফাঁকে আটকে, চনচনে মিষ্টিতে তার ওয়াক আসার মত অবস্থা, কতদিন ধরে যাচ্ছেতাই গন্ধটা এমন নাকে লেগেছিল যে মাংস খাওয়াটাই বন্ধ হওয়ার দাখিল। সেবার মা তাকে এয়সা বকেছিল যে কি বলব। 'তোকে বোকা পেয়ে মোট্টুটা যা খুশি তাই বোঝায় আর তুই উল্টে ওকে জব্দ করতে পারিস না? কি ভ্যাবাগঙ্গারাম তৈরি হচ্ছিস রে তুই!'
জঙ্গলের ভিতরে যেখানে খুব গাছেঘেরা অন্ধকার আর চুপচাপ, ছোট্ট বাঘকে নিয়ে মোট্টু সেখানে একদিন খেলতে গেছিল। খানিকক্ষণ ময়ূর আর খরগোশ আর হরিণবাচ্ছাদের ভয় দেখিয়ে হুটোপাটি করে দুজনেই ঘেমে উঠল, জঙ্গলের মাথায় তখন সুয্যিঠাকুর আগুন ঢালছেন, গরমে প্রাণ আইঢাই। পাশেই গভীর কালো জলের পুকুর, কচুরিপানা ঠেলে মোট্টুরাম তো অবলীলাক্রমে নেমে গেল তার মধ্যে, ঘাড় পর্যন্ত ডুবিয়ে খানিকক্ষণ আরাম করল, তারপর উল্টোদিকের পাড়ে উঠে এক হাঁটু কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে শুঁড়ে করে জল ছিটোতে লাগলো নিজের গায়ে। ছোট্ট বাঘ বেশ হিংসেভরা চোখে তাকিয়ে দেখল।
কি আর করে - জলকে তার বড্ড ভয়, নাহলে সেও নেমে পড়ত কখন! তো হয়েছে কি, একটা কাঠবেড়ালীকে তাড়া করে সে তো উঠে পড়েছে পুকুর পাড়ে বিরাট অশ্বত্থ গাছটার ওপরে। কাঠবেড়ালিটা তরতর করে এ-ডাল সে-ডাল হয়ে চলে গেছে একটা অতি সরু ডালের ডগায়, সে ডালটা আবার পুকুরের ওপর অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে, তার পিছনে পিছনে ছোট্ট বাঘও গেছে এগিয়ে, তারপর বেগতিক দেখে কাঠবেড়ালীটা দিয়েছে নিচের ডালটা তাগ করে এক লাফ। বেখেয়াল হয়ে ছোট্ট বাঘও ঝট করে দিয়েছে সামনের থাবাটা বাড়িয়ে - কাঠবেড়ালী তো পালিয়েছে, ওদিকে সে টাল সামলাতে না পেরে একেবারে ঝপাং করে পুকুরের জলে। পড়ে প্রথমেই একপ্রস্থ নাকানি চোবানি। হাঁকপাঁক করতে করতে কোনক্রমে জলের ওপর মাথা তুলে দেখে মোট্টুরাম পাড়ে দাঁড়িয়ে দিব্যি নিশ্চিন্তে মজা দেখছে। ছোট্ট বাঘের সেই বিপদের মধ্যেও ভীষণ রাগ হয়ে গেল। 'দাঁড়িয়ে দেখছিস কি হতচ্ছাড়া? ডুবে যাচ্ছি, আমায় টেনে তোল!' ও হরি, তার চ্যাঁচানি শুনে মোট্টুরাম হেসে গড়িয়ে পড়ে যায় আর কি। 'এই পুকুরে ডোবার মত জল আছে নাকি? উঠে আয় নিজে নিজে!'
রাগে গশগশ করতে করতে প্রাণপণে হাত পা ছুঁড়ে পাড়ে উঠে সে তো মোট্টুকে এই মারে তো সেই মারে। তখন মোট্টুরাম বলে কি, 'সব বাঘেই জন্ম থেকে সাঁতার দিতে পারে, জানিস না? নাহলে তুই জল থেকে উঠে এলি কি করে?সাধে কি তোর মা তোকে বলে ভ্যাবাগঙ্গারাম!' - সত্যিই তো! আবার সে নিজের বোকামির জন্য বন্ধুর কাছে অপদস্থ হলো। যাক গে, এই বলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল যে, বিপদে পড়ে নিজের একটা সহজাত ক্ষমতা তো জানা হয়ে গেল? আর কখনো জলকে ভয় পেতে হবে না, সেটা একটা মস্ত লাভ!